সম্পর্কের যত্ন নিলে সম্পর্ক দীর্ঘ স্থায়ী হয়। আমার পরনের অটো গিয়ারের বেল্টটা কিনেছিলাম ঢাবিতে অনার্স পড়ার সময়। তার আর আমার সম্পর্ক প্রায় তেত্রিশ বছর। মানে এখনো সে বেল্ট আমি ব্যবহার করছি। অনেকে ভাবছেন এটা কেমন করে সম্ভব? আমি মোটা হই সেও গিয়ার ছাড়ে, মোটা হই গিয়ার ছাড়ে। এমন করতে করতে এখন শেষ মাথায় আছি। তবু ফেলতে মায়া লাগে। এতদিনের আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখার সম্পর্ক! কী করে হুট করে ফেলে দেই।মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কটাও কি এমন? শুধু এ্যাডজাস্ট করে যাওয়া? বোঝাপড়া অবশ্যই বড় বিষয়তবে সবকিছু নয়। নারী – পুরুষের সম্পর্কে একটাম্যাজিক থাকতে হয়। যা বোঝাপড়ার অনেক উর্ধ্বে।যাকে আপনি প্রেম বলতে পারেন, মায়া বলতে পারেন,ভালোবাসা বলতে পারেন। প্রেম, মায়া, ভালোবাসা একটি স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতি। আরোপিত নয়। বোঝাপড়া বললে কেমন আরোপিত মনে হয়।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর হৈমন্তী গল্পে অপুর জবানীতে বলেছিলেন,” আমি পাইলাম ইহাকে পাইলাম, কাহাকে পাইলাম। এ যে দুর্লভ এ যে মানবী। ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে “। সেই রহস্য উন্মোচনে তাড়িত হয়েই এক একটি পুরুষ জীবন নিবিষ্টচিত্তে কেটে যাবার কথা। কথা থেকে যায়, সেই ম্যাজিকটা থাকতে হবে। সেইযাদুটা কাজ করতে হবে। সম্পর্কে সেই যাদু না থাকলেএকশত বছর একত্রে ঘর করলেও আলুনি লাগবে। সম্পর্কের জোড় প্রতিষ্ঠিত হবে না তার প্রমাণ হচ্ছেশরৎচন্দ্রের বিলাসী গল্পের ন্যাড়ার আত্মীয়ার উক্তিতে।আত্মীয়ার স্বামী মারা যাওয়াতে ভীষণ মর্মাহত হয়েতিনি সতীদাহে পর্যন্ত যেতে রাজি আছেন কিন্তুস্বামীর লাশটা নিয়ে একঘরে রাত কাবার করতে হবে শুনে চিৎকার করলেন, ওরে বাপরে আমি একলা থাকতে পারবো না। মানে তাদের মধ্যে সেই ম্যাজিক টাছিল না।
পাড়ায় এক পড়শী মারা গেলেন। তখন আমরা ছোট। উনাকে কাকী বলে ডাকতাম। অপূর্ব রূপসী বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তেমনটি। রাতভর ব্লিডিং হবার পর সকালের দিকে মারা যান। লাশ দেখতে গেলাম, রক্তশূন্য ফ্যাকাশে। উনার স্বামীটি উঠোনে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছিলেন। অনেক পড়শী পুরুষ “আহ্ কী মানিক জোড় ছিল “! বলে আফসোস করতে করতে যাচ্ছিলেন। কেউ কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। উনার শোক প্রকাশের উন্মাদনা দেখে দম্পতির প্রেমের গভীরতা নিরূপণে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অনেকে। স্ত্রীর জন্য এমন শোক প্রকাশের ঘটনা আশে পাশে চৌদ্দ গ্রামে আছে কিনা তাও ঘেটেঘুটে বিস্তর গবেষণা করে দেখা হল। যাই হোক শোকের ঝড়ও একসময় শান্ত হয়ে আসে। উনারটাও হলো। তবে শোক প্রকাশের পুরুষতান্ত্রিক ধরণটা সবারই খুব মনপুত হলো। হাটে বাজারে, চা স্টলে, আড্ডাস্থলে শুধু একটিই কথা, আহা কী প্রেম ছিল গো –।
কাকী মারা যাবার তিরিশ দিনও যায়নি কাকা বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। যারা এতদিন প্রেমের জয়গানে ব্যস্ত ছিলেন মুখরিত ছিলেন বাচাল বচনে তাদের মুখে ছাই পড়লো। শোনা গেল কাকার সাথে নাকি নতুন বধূ একই অফিসে চাকুরি করেন। আরো কিছু কানাঘুষা বাতাসে প্রবাহিত হতে লাগলো। যারা এতদিন শোকের প্রশংসায় মনশ্চক্ষে প্রেমের তাজ মহল গড়েছিলেন তারাই বলা শুরু করলেন, –পুরুষ মানুষ বিয়ে না করলে হবে! এতোগুলা ছেলেমেয়ে সাগরে ভেসে যাবে যে “!
এই তো গেল একটি দিক অন্য দিকও আছে। শরৎ বাবুর বিলাসী গল্পে আবার যাই। দেড়মাস একটানা বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে অপরিসীম সেবা দিয়ে বিলাসী যেভাবে মৃত্যুঞ্জয়কে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনলো তাকে কী বলবেন। শুধুই কী মানবসেবা! নাকি তার চেয়ে বেশি কিছু? একা নির্জনে একটি মেয়ে রাতের পর রাত! মৃত্যুঞ্জয় রাতের যে কোন প্রহরে মারা যেতে পারতো। সে ভয়ও ছিল। বিলাসীর মনে যে শক্তি ছিল তা হচ্ছে ” প্রেম “। এ এমন এক শক্তি যা দিয়ে অসাধ্য সাধন করা যায়। বিলাসী যেমন তার ভালোবাসার মানুষকে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে ঠিক তেমনি বাংলা সাহিত্যে বেহুলাকে দেখতে পাই লখিন্দরের জন্য তার প্রাণপাত করা ভালোবাসা।ভালোবাসা সর্বসময়েই নিঃস্বার্থ। স্বার্থের স্পর্শে ভালোবাসা কুলুষিত হয়। নষ্ট হয়। নষ্ট হৃদয় নিয়ে কাউকে ভালোবাসা যায় না। ভালোবাসা কিছু প্রত্যাশা করে না। ভালোবাসার স্রোত অদম্য। ভালোবাসাকেস্বার্থপরতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে যেও না তাহলেসে তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সুদূর বিরহী কোন
অচিনপুরের দ্বীপমালায়। ভালোবাসার মানুষের হাতটা কখনো ছেড়ে যেও না। লেখক ১৩/০৩/২০২৫ মাহবুবুল আলম ( কনক)