প্রিন্ট এর তারিখঃ এপ্রিল ২৮, ২০২৫, ১০:৫৭ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ এপ্রিল ১৭, ২০২৫, ৩:১১ পি.এম
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ জলে কুমির, ডাঙায় বাঘের সঙ্গে ডাকাতেরও ভয় বেড়েছে
মোঃ শামীম হোসেন - স্টাফ রিপোর্টার
মধু সংগ্রহ করছেন মৌয়ালেরা। দেশে প্রাকৃতিক মধুর সবচেয়ে বড় উৎস সুন্দরবন। এই বনের গহিনে মৌচাকে মধু জমায় মৌমাছি। আর সেই চাক খুঁজে বের করে মধু সংগ্রহ করেন একদল মানুষ। তাঁদের বলা হয় মৌয়াল। মধু আহরণের মৌসুম এলেই দল বেঁধে সুন্দরবনে ছুটে যান তাঁরা। ঘ্রাণ ও স্বাদ ‘অতুলনীয়’ সুন্দরবনের এই মধু সংগ্রহ করতে ‘জীবনবাজি’ রাখতে হয় মৌয়ালদের। এত দিন শুধু নদীতে কুমির আর ডাঙায় বাঘের ভয় ছিল। কিন্তু এবার যুক্ত হয়েছে বনদস্যুদের ভয়। মৌয়ালরা বলছেন, কয়েকটি দস্যু দল মৌয়ালদের কাছ থেকে টাকা আদায় করছে। সুন্দরবনে এখন চলছে মধু সংগ্রহের মৌসুম। ১৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার খুলনার দাকোপ উপজেলার মৌয়াল নৃপেন সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বাপ-দাদার পেশা হিসেবে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করে আসতিছি। প্রতিটি বছর মধু কাটার মৌসুমের অপেক্ষায় থাকি। বনের সাপ, কুমির ও বাঘের ভয়ে কখনো পিছুপা হইনি। তবে এবার ডাকাতির ভয়ে জঙ্গলের বেশি ভেতরের দিকে যাইনি। তাই মধু একটু কম পাইছি। মঙ্গলবার এলাকায় ফিরে ৯০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে দিছি। ১ এপ্রিল শুরু হয়েছে সুন্দরবনে মধু আহরণ মৌসুম। আগামী ৩১ মে পর্যন্ত টানা দুই মাস বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে চলবে মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ। গতকাল সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার মদিনাবাদ গ্রামের মৌয়াল আবুল কালাম বলেন, ‘টানা ১৪ দিন সুন্দরবনে অবস্থান করে ১৭ মণ মধু নিয়ে আজ লোকালয়ে ফিরে এসেছি। আমরা এক নৌকায় ৭ জন ছিলাম। আগে বেশ কয়েক বছর বনে ডাকাতির চাপ ছিল না। নির্বিঘ্নে মোম-মধু কাইটে আনতি পারতাম। এবার সবার মধ্যে ডাকাত দলের ভয়। মন খুলে জঙ্গলে চলা যায় না।’ আগে বেশ কয়েক বছর বনে ডাকাতির চাপ ছিল না। নির্বিঘ্নে মোম-মধু কাইটে আনতি পারতাম। এবার সবার মধ্যে ডাকাত দলের ভয়। মন খুলে জঙ্গলে চলা যায় না। প্রতিবছর সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে যান কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার বনজীবী মনিরুল ইসলাম। গতকাল সকালে মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘নদীতে কুমির আর ডাঙায় বাঘের ভয়ের সঙ্গে এবার ডাকাতেরও ভয়। তবে জীবন বাজি রেখে ৮ জনের মৌয়াল দলের সঙ্গে একটি নৌকায় আমিও সুন্দরবনে এসেছি। ভয়ে লোকালয়ের কাছাকাছি বনে থাকায় মোবাইলে নেটওয়ার্ক পাচ্ছি। তবে বনের মধ্যে এবার চাকের পরিমাণ বেশি মনে হচ্ছে। মধুও ভালোই পাচ্ছি।’ সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, গত বছর মধু আহরণ থেকে ৫০ লাখ ৩৯ হাজার ৮০০ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এবার পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে ৪ হাজার ৪৬০ জন মৌয়াল ৬৭৫টি নৌকা নিয়ে মধু আহরণে সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি নিয়েছেন। সুন্দরবনে নির্বিঘ্নে মধু আহরণের জন্য বন বিভাগের টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ৪ হাজার ৪৬৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮ কুইন্টালে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও কমে হয় ২ হাজার ৮২৫ কুইন্টাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল। এ বছর সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন এলাকায় মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কুইন্টাল। দস্যু বাহিনীর সদস্যদের ধরতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ৯ এপ্রিল সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে ডাকাত করিম শরীফ বাহিনীর হাতে জিম্মি ৬ নারীসহ ৩৩ জেলেকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। দস্যুদলের উৎপাতকয়রার মহেশ্বরীপুর এলাকা থেকে মধু কাটতে যাওয়া কয়েকজন মৌয়াল বলেন, সুন্দরবনে ঢুকতেই তাঁদের দস্যুদল ‘দয়াল বাহিনীকে’ জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া ‘দুলাভাই বাহিনী’ নামের আরেক দস্যুদলকে দিতে হয়েছে জনপ্রতি সাড়ে তিন হাজার টাকা। এভাবে কয়েকটি দস্যুদল বনজীবীদের জিম্মি করে টাকা আদায় করছে। জেলে-বাওয়ালিরা বলছেন, এখন সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, মামা-ভাগনে বাহিনীসহ কয়েকটি বনদস্যু দল। এসব বাহিনীর হাতে অনেক জেলে ও মৌয়াল মাছ, মধু ও টাকা খোয়াচ্ছে। এসব দস্যু বাহিনীর সদস্যদের ধরতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ৯ এপ্রিল সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে ডাকাত করিম শরীফ বাহিনীর হাতে জিম্মি ৬ নারীসহ ৩৩ জেলেকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। এর আগে ৭ এপ্রিল সুন্দরবনের পুরোনো ঝাপসি ফরেস্ট অফিসসংলগ্ন এলাকায় কোস্টগার্ড সদস্যরা অভিযানে গেলে তাঁদের দেখে ২টি একনলা বন্দুক, ১১টি ফাঁকা কার্তুজ ও অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম ফেলে পালিয়ে যায় ডাকাত করিম শরীফের বাহিনী। কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ইশমাম হাসান ফাহিম বলেন, ‘বনদস্যুদের দমনে আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি। এর আগে সুন্দরবন থেকে বন্দুক, গুলিসহ ডাকাত সর্দার আসাবুরকে তাঁর সহযোগীসহ আটক করা হয়েছে। করিম শরীফ বাহিনীকেও স্থির হতে দিচ্ছি না। একের পর এক অভিযান চলছে। জননিরাপত্তায় কোস্টগার্ডের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’ যেভাবে মধু সংগ্রহবনের ভেতর অসংখ্য শ্বাসমূল ও বিভিন্ন গাছের কাঁটা থাকে। এসব যেন পায়ে না ফুটে যায়, তাই বনে পা ফেলার আগে বিশেষ প্লাস্টিকের জুতা পরে নেন মৌয়ালরা। নিজেরা প্রস্তুত হওয়ার পাশাপাশি মৌমাছির চাক কেটে মধু সংগ্রহের জন্য নিতে হয় দা, বড় ড্রাম, বড় পাত্র ও মৌমাছির কামড় থেকে বাঁচার জন্য মুখে দেওয়ার নেট জাল ও গামছা। নৌকা থেকে বনে নেমেই মৌয়ালরা ভাগ হয়ে ২০-২৫ হাত দূরত্ব রেখে মৌচাক খুঁজতে বনে হাঁটতে শুরু করেন। ঘন জঙ্গলে কেউ যাতে দলছুট না হয়ে পড়েন, সে জন্য একটু পরপর শব্দ করা হয়। সেই শব্দ শুনে পাল্টা শব্দের মাধ্যমে বাকিরা তাঁদের অবস্থান জানান দেন। এভাবে চাক খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত বনের ভেতর হাঁটতে থাকেন তাঁরা। মৌচাক খুঁজে পেলেই সবাই একত্র হয়ে শুরু হয় চাক কাটার প্রস্তুতি। চাক কাটার জন্য একজন নির্দিষ্ট গাছি থাকেন, যিনি গাছে উঠে চাক কাটেন। বনদস্যুদের দমনে আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি। এর আগে সুন্দরবন থেকে বন্দুক, গুলিসহ ডাকাত সর্দার আসাবুরকে তাঁর সহযোগীসহ আটক করা হয়েছে। করিম শরীফ বাহিনীকেও স
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত